ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শীর্ষ নেতাদের ওপর দফায় দফায় হামলা হয়েছে। দলটির ‘১৬ জুলাই: মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি পণ্ড করতে বিভিন্ন স্থান থেকে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী দুই দিন আগে আশপাশের এলাকা থেকে গোপালগঞ্জ শহরে হাজার হাজার নেতাকর্মী জড়ো করে আওয়ামী লীগ। টার্গেট ছিল এনসিপিকে ঢুকতে দেওয়া হলেও তাদের জীবিত বের হতে দেওয়া হবে না। বিশেষ করে শীর্ষ নেতাদের হত্যা করা।


এদিকে এ মিশন সফল করতে স্বয়ং গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত থেকে মোবাইল ফোনে গোপালগঞ্জে একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলেন। এনসিপির বিরুদ্ধে জনগণকে উসকে দিতে বেশকিছু অডিও বার্তাও পাঠান। এছাড়া পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক সিনিয়র নেতা সমন্বয় করেন। এমনকি ভারতে পলাতক ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ছিলেন আরও এক ধাপ এগিয়ে। ফেসবুক লাইভে এসে তিনি সরাসরি হামলা চালানোর নির্দেশনা দেন।


একটি অডিও বার্তায় শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালকে বলেন, ‘ওরা (এনসিপি) নাকি গোপালগঞ্জে যাচ্ছে। টুঙ্গিপাড়ায় আমার বাবার কবর ভেঙে ফেলার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এবার টুঙ্গিপাড়ায় হামলা চালাবে। তোমরা বসে আছ কেন? যে যেভাবে পার প্রতিহত কর। গোপালগঞ্জে কোনোভাবেই যাতে ওরা ঢুকতে না পারে। কোনো ধরনের কর্মসূচি যাতে করতে না পারে। মনে রাখবা, গোপালগঞ্জের মাটি থেকে ওদের কেউ যাতে অক্ষত অবস্থায় ফিরে যেতে না পারে।’


আরেকটি অডিও বার্তায় শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও শহরের বেদ গ্রামের বাসিন্দা নিউটন মোল্লাকে বলেন, ‘তোমরা ওখানে (গোপালগঞ্জে) বসে কী কর। ওরা (এনসিপি) বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন জড়ো করার চেষ্টা করছে। পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা ও ফরিদপুরসহ আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে লোকজন একত্রিত করে গোপালগঞ্জে ঢুকবে। এরপর টুঙ্গিপাড়ায় যাবে। যেভাবে পার ওদের প্রতিহত করতে হবে। টুঙ্গিপাড়ায় যাতে কোনোভাবেই ওরা ঢুকতে না পারে। আর যদি টুঙ্গিপাড়ায় ঢুকেই পড়ে, তাহলে একজনও যাতে জীবিত অবস্থায় ওখান থেকে ফিরে যেতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।’


অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পরদিন বুধবার গোপালগঞ্জ পৌর পার্ক মাঠে এনসিপির কর্মসূচির দিন সকালে নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালের নেতৃত্বেই স্থানীয় চর দুর্গাপুর এলাকায় পুলিশের গাড়িতে হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে এনসিপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার বিষয়টি এলাকায় জানান দেয় আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। শহরের মোহাম্মদপাড়ার বাসিন্দা এই আতাউর রহমান পিয়ালের নেতৃত্বেই পরে এনসিপি নেতাদের গাড়িবহরে কয়েক দফা গুলি ও বোমা হামলা চালানো হয়।


একইভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিউটন মোল্লার নেতৃত্বে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং জেলা কারাগারে হামলা চালানো হয়। স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, নিউটন মোল্লার প্রধান টার্গেট ছিল কারাগারের প্রধান ফটক ভেঙে সেখানে আটক থাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিএম শাহাবুদ্দিন আজমসহ দলের নেতাকর্মীদের বের করে আনা। যদিও পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর শক্ত অবস্থানের কারণে তার এ অপচেষ্টা সফল হয়নি। এছাড়া গোপালগঞ্জ জেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাসুদ রানার নেতৃত্বে ওইদিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়িতে হামলা চালানো হয়।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেবল নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগই নয়, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগসহ দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে একাধিকবার টেলিফোনে কথা বলেন। গোপালগঞ্জের মাটিতে এনসিপি যাতে কোনোভাবেই তাদের কর্মসূচি পালন করতে না পারে, সেজন্য প্রত্যেককে তিনি নির্দেশনা দেন। শেখ হাসিনার নির্দেশের পর এনসিপির কর্মসূচি পণ্ড করাসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের হত্যা করতে গোপালগঞ্জে থাকা দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা চতুর্দিক থেকে একযোগে হামলা চালান। এ সময় নেতাকর্মীদের সমন্বয় করেন কলকাতায় থাকা শেখ হাসিনার ফুপাতভাই গোপালগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, লন্ডনে বসে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য আব্দুর রহমান, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও শরীয়তপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য ইকবাল হোসেন অপু এবং গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুব আলী খান ও সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল আলম কাজল। তাদের বাইরে গোপালগঞ্জসহ আশপাশের জেলা-উপজেলায় আত্মগোপনে থাকা নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। কলকাতায় আত্মগোপনে থেকেই ফেসবুকে লাইভে এসে তিনি মাঠের কর্মীদের এনসিপির কর্মসূচিতে হামলা করতে নির্দেশনা দেন। স্থানীয় পর্যায়ে নারীদের এ কাজে সংগঠিত করেন কলকাতায় আত্মগোপনে থাকা গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল আলম কাজলের স্ত্রী ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ইয়াসমিন আলম। যদিও বিষয়টি জানার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশ তাকে আটক করে। ১ জুলাই থেকে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করছে এনসিপি। ইতোমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় কর্মসূচি পালন করে দলটি। মাসব্যাপী এ কর্মসূচির অংশ হিসাবে বুধবার ছিল গোপালগঞ্জে পদযাত্রা ও সমাবেশের আয়োজন। আগের দিন মঙ্গলবার দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এ কর্মসূচিকে ‘১৬ জুলাই: মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। গোপালগঞ্জে কর্মসূচি পালন শেষে এনসিপির নেতাকর্মীদের শরীয়তপুরের জাজিরায় আরেকটি কর্মসূচি পালনের কথা ছিল।


মাজার ভাঙার অপপ্রচার : স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, গোপালগঞ্জে এনসিপির শান্তিপূর্ণ এই কর্মসূচিকে ঘিরে শুরু থেকেই চলে নানা অপপ্রচার। বিশেষ করে এনসিপির নেতাকর্মীরা দলবল নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের কবর ভাঙচুর করবেন-এমন একটি অপপ্রচার মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দেশ-বিদেশ থেকে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ অপপ্রচার চালিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি গোপালগঞ্জের স্থানীয় সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করা হয়। অপপ্রচারকারিরা জানত এভাবে অপপ্রচার চালাতে পারলে আবেগে বহু মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে।


অপরদিকে এনসিপি যাতে শরীয়তপুরের জাজিরায় কর্মসূচি পালন করতে না পারে, সেজন্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও শরীয়তপুর-১ (জাজিরা-পালং) আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য ইকবাল হোসেন অপু আগে-ভাগেই দলের নেতাকর্মীদের এমন নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন।


মাইকে মিথ্যা ঘোষণা : প্র্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পৌর পার্কের পাশেই ঐতিহাসিক কোর্ট মসজিদ থেকে উসকানিমূলক ঘোষণা দিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দফায় দফায় মাইকে ঘোষণা দিলে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে আসে। ওই সময় মাইকে এও বলা হয়, ‘পুলিশ এবং সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি করছে। এতে অনেক লোকজন নিহত হয়েছেন।’ এ ধরনের প্রচারণায় সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। এর আগে হামলা চালাতে ঘোষের চর, চর মানিকদহ, ডুমদিয়া, হরিদাসপুর, উলিপুর, পাইককান্দি, গোনাপাড়া, ফকিরকান্দি, বেদগ্রাম, সোনাকুর, গোবরা, রঘুনাথপুরসহ আশপাশের গ্রাম থেকে বিপুলসংখ্যক লোকজন শহরের পৌর পার্ক এলাকায় জড়ো করা হয়।


মার্চ টু গোপালগঞ্জ কর্মসূচি পালন করতে দুপুরের মধ্যেই এনসিপির নেতাকর্মীরা গাড়ির বহর নিয়ে শহরের পৌরপার্ক এলাকায় প্রবেশ করে। ঢাকা-মাওয়া-টেকেরহাট হয়ে ফরিদপুর-বরিশাল হাইওয়ে দিয়ে জালির পার, বানিয়ার চর, ভেন্নাবাড়ি, সাতপাড়া, বৌলতলী, করপাড়া, বাংসুর, উলিপুর, ভেড়ার বাজার, পুলিশ লাইন হয়ে দুপুর পৌনে ২টার দিকে শহরে ঢোকেন তারা। এর কিছুক্ষণ আগেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এনসিপির মঞ্চ ভাঙচুর করে। ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সমাবেশস্থলে লাঠিসোঁটা নিয়ে অতর্কিত হামলা চালানো হয়। জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে হামলাকারীরা মঞ্চে থাকা সাউন্ড বক্স, মাইক এবং চেয়ার ভাঙচুর করে। উপস্থিত এনসিপি নেতাকর্মীদের ওপরও হামলা চালানো হয় এ সময়।


সড়কে গাছ ফেলে প্রতিবন্ধকতা : এনসিপির নেতাকর্মীরা গোপালগঞ্জ শহর হয়ে টুঙ্গিপাড়া যাবেন-এমন খবর চাউর হলে ২০ কিলোমিটার সড়কজুড়ে শতাধিক গাছ ফেলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। ঘোনাপাড়া, খালেকের বাজার, সিংগিপাড়া, গিমাডাঙ্গা, পাটগাতি বাসস্ট্যান্ড হয়ে টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে দা, বঁটি, লাঠিসোঁটাসহ দেশীয় অস্ত্র হাতে পাহারা বসানো হয়। যদিও টুঙ্গিপাড়ায় এনসিপির কোনো কর্মসূচি ছিল না। তবুও অপপ্রচার চালিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষুব্ধ করে তোলা হয়।


সোহেল তাজও দায়ী করলেন : এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বৃহস্পতিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ বলেন, গোপালগঞ্জে এ হামলার উদ্দেশ্য ছিল এনসিপি নেতা নাহিদ, সার্জিস, হাসনাত ও জারাকে হত্যা করা। তিনি এও বলেন, আমি আশ্চর্য হব না যদি ডেভিল রানি (শেখ হাসিনা) নিজেই এ নির্দেশ দিয়ে থাকেন।


Post a Comment

Previous Post Next Post